ইন্দো-প্যাসিফিকে উপস্থিতি বাড়াবে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’

২০২০ সাল যখন শেষের দিকে, তখন থেকেই ২০২১ সালের শুরুতে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির নতুন নির্মিত দৈত্যাকৃতির বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’ ভারত মহাসাগরে মোতায়েনের কথা আলোচনায় আসতে থাকে। 

‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অংশ হিসেবে এই সামরিক কর্মকাণ্ড ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে পরিবর্তন আনবে। নিকেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে ব্রিটেনকে ‘কোয়াড’ জোটের পঞ্চম সদস্য হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ‘কোয়াড’ হলো এক কৌশলগত জোট, যার মাঝে রয়েছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। ২০২০ সালে ‘কোয়াড’ নতুন আকার নিতে শুরু করে, যখন ভারত অবশেষে বঙ্গোপসাগরে অনুষ্ঠিত ‘এক্সারসাইজ মালাবার’ নৌমহড়াতে গ্লোবাল ব্রিটেনের অংশ অস্ট্রেলিয়াকে আমন্ত্রণ জানায়। 

নিকেই এশিয়া জানায়, আপাতত ব্রিটিশ নৌবাহিনী হয়তো মার্কিন নৌবাহিনীর সহায়ক হিসেবেই কাজ করবে। করোনা সংক্রমণের কারণে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ অকার্যকর হয়ে পড়ে, তখন পূর্ব এশিয়াতে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এর সমান্তরালে জুলাই মাসে মার্কিন নৌবাহিনীর আরেক উভচর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘বনহোমি রিচার্ড’ মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যায়। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি রাষ্ট্র কোনো অঞ্চলে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, তার একাংশ নির্ধারিত হবে সেখানে তার সামরিক শক্তি মোতায়েনের সক্ষমতার ওপর। ব্রিটিশরা চাইছে ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এশিয়াতে অবস্থান শক্তিশালী করতে। 

জাপানের কিওদো নিউজ জানায়, এশিয়ায় ব্রিটেনের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের পেছনে জাপানের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। ‘কুইন এলিজাবেথ’ ২০২১ সালে জাপানি ও মার্কিন নৌবাহিনীর সাথে মহড়া দেবে। আর জাপান সফরের সময় এর ‘এফ ৩৫বি’ স্টেলথ যুদ্ধবিমানগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আইচি প্রিফেকচারে অবস্থিত মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায় পাঠানো হবে। অর্থাৎ জাহাজটির ইন্দো-প্যাসিফিকে স্থায়ীভাবে মোতায়েনের পেছনে জাপানের একটি বড় ভূমিকা থাকবে। এছাড়াও জাহাজটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওমানের দুকমে বিশাল ড্রাইডক তৈরি করা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ সরকার দুকমের লজিস্টিকস ঘাঁটি তিনগুণ করার লক্ষ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এর মাধ্যমে ওমানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ট্রেনিং কর্মকাণ্ডও বৃদ্ধি পাবে।

ব্রিটেনের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের সাথে চীনের ব্যাপারে ব্রিটিশ নীতির যোগাযোগ রয়েছে। হংকংয়ে চীনা দমনপীড়নের ব্যাপারে ব্রিটিশ রাজনৈতিক অবস্থান চীনের বিরক্তির উদ্রেক করেছে। একইসাথে তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতেও ব্রিটেন চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে তা একইসাথে ব্রিটেনকে পূর্ব এশিয়াতে নিজের অবস্থান জানান দিতে সহায়তা করেছে। চীনারা এশিয়ায় রয়্যাল নেভির যুদ্ধজাহাজের আবির্ভাবকে ‘সামরিকভাবে অগুরুত্বপূর্ণ’ বলে আখ্যা দিচ্ছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসের লেখায় সামরিক বিশ্লেষক সং ঝংপিং বলেন, ‘কুইন এলিজাবেথ’ যুদ্ধজাহাজ ও এর বিমানগুলো এখনো পুরো যুদ্ধ সক্ষমতা অর্জন করেনি। এমতাবস্থায় জাহাজটাকে ইন্দোপ্যাসিফিকে পাঠালে এর দুর্বলতাগুলোই প্রকাশ পাবে। 

চীনারা ব্রিটিশদের এই সিদ্ধান্ত পছন্দ করেনি মোটেই। গত জুলাই মাসে ব্রিটেনের দ্য সানডে টাইমস পত্রিকার সাথে কথা বলতে গিয়ে লন্ডনে চীনা রাষ্ট্রদূত লিউ শিয়াওমিং পূর্ব এশিয়াতে ব্রিটেনের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের পরিকল্পনা বাতিল করার অনুরোধ করেন। তিনি আরো বলেন, চীনকে ভয় দেখাতে এমনটি করা হলে, তা হবে অনেক বড় ভুল। ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চাইছে। তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পথ নয়। এছাড়াও তিনি লন্ডনকে উপদেশ দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বিরুদ্ধে ‘দল বাঁধা’ ব্রিটেনের ঠিক হচ্ছে না। 

২০০৯ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে কুইন এলিজাবেথের কমিশনিং করা হয়। এরপর থেকে জাহাজটি অপারেশনে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে অংশ নিচ্ছে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির মাঝেও এই ট্রেনিং অব্যাহত রাখা হয়; যা ব্রিটেনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের গুরুত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০২১ সালের ইন্দো-প্যাসিফিক মিশন হবে জাহাজটির জন্য প্রথম অপারেশনাল মিশন। এই ৬৫ হাজার টনের জাহাজটি একই রকমের দুটি জাহাজের একটি। অপর জাহাজটি হলো ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’, যা ২০২৩ সালের আগে অপারেশনাল হবে না। 

২০২১ সালে কুইন এলিজাবেথের সাথে কোন কোন জাহাজ থাকবে, সেটি এখনই বলা না গেলেও সাধারণভাবে জাহাজটির ব্যাটল গ্রুপে একটি ‘টাইপ ২৩’ ফ্রিগেট, একটা ‘টাইপ ৪৫’ ডেস্ট্রয়ার, একটি সাবমেরিন ও একটি সাপ্লাই জাহাজ থাকার কথা রয়েছে বলে জানায় নেভি রিকগনিশন। তবে ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো ব্যাটল গ্রুপ তৈরি করা হলে সেখানে মার্কিন ও ডাচ নৌবাহিনীর জাহাজও ছিল। অর্থাৎ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর নিরাপত্তা শুধু ব্রিটিশ জাহাজের হাতেই থাকছে না। মিশনের সময় এই জাহাজ মোট ১৪টি ব্রিটিশ বিমান বাহিনী এবং মার্কিন ম্যারিন কোরের ‘এফ-৩৫’, নয়টি হেলিকপ্টার বহন করবে; যার মাঝে ছয়টি ‘মারলিন এইচএম-২’ সাবমেরিন ধ্বংসী হেলিকপ্টার ও তিনটি ‘ক্রোসনেস্ট’ আর্লি ওয়ার্নিং হেলিকপ্টার। জাহাজটি সর্বোচ্চ ২৪টি এবং জরুরি ভিত্তিতে ৩৬টি ‘এফ-৩৫বি’ বহন করতে সক্ষম। 

১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধের পর থেকে ব্রিটেন সুয়েজ খালের পূর্বে তার বেশিরভাগ অঞ্চল ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়। ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝে ব্রিটেন নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল থাকলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই তারা বিশ্বব্যাপী তাদের ভূমিকাকে নতুন করে দেখতে থাকে। এটিই সেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তা, যার ফসল হিসেবেই ১৯৯০-এর দশকের শেষে দুটি বড় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দো-প্যাসিফিকে ব্রিটেন প্রভাব বিস্তারের সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। শত বছরের মাঝে যা তাদের সবচেয়ে বড় সুযোগ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //